• নির্বাচনী সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বিবেচনায় তালিকা তৈরি করা হয়েছে
• সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসিকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে
• ঝুঁকিপূর্ণ আসনগুলোতে মোট ভোটারের কোথাও ১২ শতাংশ, কোথাও ৪৮ শতাংশই সংখ্যালঘু।
• ৯৬টি সংসদীয় আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার ১২ শতাংশের বেশি।
• ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির হিসাবে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু ভোটার আছেন খুলনা-১ আসনে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার ১২ শতাংশের বেশি, দেশে এমন সংসদীয় আসন রয়েছে ৯৬টি। এর মধ্যে ৬১টি আসনই সংখ্যালঘুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এসব আসনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা বলে আসছে।সংখ্যালঘুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আসনের তালিকাটি তৈরি করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এর আগের সংসদ নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা, বিভিন্ন এলাকায় নানা সময়ে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা করা হয়েছে।তবে তালিকা করার ক্ষেত্রে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব আসনের মোট ভোটারের কোথাও ১২ শতাংশ, কোথাও ৪৮ শতাংশই সংখ্যালঘু।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির হিসাবে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু ভোটার আছেন খুলনা-১ আসনে। এই আসনের প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোটারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। গোপালগঞ্জ-৩ আসনে সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন প্রায় ৪৫ শতাংশ। ২৪ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন দিনাজপুর-১, ২ ও ৪, বাগেরহাট-১, খুলনা-৫ ও ৬, সাতক্ষীরা-৩, বরিশাল-১, পিরোজপুর-১, সুনামগঞ্জ-২, মৌলভীবাজার-৪, পঞ্চগড়-২, ঠাকুরগাঁও-১ ও ৩ আসনে। এর বাইরে কক্সবাজার-১, পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভোটার রয়েছেন।
এর মধ্যে গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার (ঠাকুরগাঁও-১ আসন) জগন্নাথপুর ইউনিয়নে সিংগিয়া শাহাপাড়া গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেছেন।
২০০১ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা বেশি ঘটেছিল। এবারের নির্বাচনের আগে করা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তালিকাতেও খুলনা বিভাগের ১৫টি আসন সংখ্যালঘুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ-১ ও ৪, যশোর-৪, ৫ ও ৬, মাগুরা-২, বাগেরহাট-১, ২ ও ৩, খুলনা-১, ৫ ও ৬, সাতক্ষীরা-২, ৩ ও ৪।
বিগত নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা কথা জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁরা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, এটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসিকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার (যশোর–৪) মালোপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট এবং পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এবারও মালোপাড়ার সংখ্যালঘুরা শঙ্কিত।
২০১৪ সালে সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছিলেন মালোপাড়ার বিশ্বজিৎ সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের হামলা–মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।
বিএনপি জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থীরা ৪টি আসনে ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন। এর মধ্যে একটি আসন যশোর-৫ (মনিরামপুর)। এই আসনও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা ২১টি আসনে এবার বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন। আরেকটি আসনে (কক্সবাজার–২) জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থী আপেল প্রতীকে বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এই ২২ আসনের মধ্যে ১১টি আসনকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ঝুঁকিপূর্ণ বলছে। আসনগুলো হচ্ছে পিরোজপুর-১, সাতক্ষীরা-২, সাতক্ষীরা-৪, খুলনা-৫ ও ৬, বাগেরহাট-৩, নীলফামারী-২ ও ৩, দিনাজপুর-১ এবং ঠাকুরগাঁও-২।
দিনাজপুরের ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪টি আসনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। তবে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, অন্য যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় এবার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতার কোনো শঙ্কা এখন পর্যন্ত নেই। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা পিরোজপুর-১ (সদর-নাজিরপুর-নেছারাবাদ) আসনে ২০-দলীয় জোটের প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর শামীম বিন সাঈদী। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে।
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের প্রার্থীরা যেখানে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে জেতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো পক্ষ যেন সংখ্যালঘুদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাংসদদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ ও এবারের প্রার্থী দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল, তাদের ওপর হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছে ঐক্য পরিষদ। গাইবান্ধা-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুব আরা গিনির বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছিল ঐক্য পরিষদ। তিনি এবারও প্রার্থী।
৬ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বলেছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রতিটি এলাকার মাস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা এখন থেকেই তৈরি করতে হবে। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তাদের আটক করতে হবে।
নির্বাচনকালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষায় নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি বসানো, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে কমিটি গঠন।
এ বিষয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিলেও কখনো তা রক্ষা করা হয়নি। সংখ্যালঘুদের শঙ্কা ও উদ্বেগ দূর করার দায়িত্ব সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে নিতে হবে।
মন্তব্য
মন্তব্য করুন প্রথমআলো.কম এ
Deepak Eojbalia
২২ ডিসেম্বর, ২০১৮
Create trust among the minority communities.
Sengupta
২২ ডিসেম্বর, ২০১৮
প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিলেও কখনো তা রক্ষা করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২২ ডিসেম্বর, ২০১৮
Create trust for the minorities.