মাত্র ছয় মাস আগে একটি সেমি পাকা বাড়ি তুলেছিলেন বিধবা জাহানারা বেগম। ঘরের পাশেই ছিল ছোট চায়ের দোকান। ছয় সন্তানকে নিয়ে ঘরে থাকতেন আর চায়ের দোকান থেকে আয় দিয়ে পরিবারের খরচ মেটাতেন। কিন্তু জাহানারার এই ছোট্ট সম্বলটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরনের কাপড় ছাড়া জাহানারা বেগম বা তার ছয় সন্তানের এখন আর কিছুই নেই।
২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার দক্ষিণ রায়কোট ইউনিয়নের বেতাগা গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতার শিকার হয় এই পরিবারটি। ধানের শীষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাকে কেন্দ্রে করে চালানো এই হামলায় গ্রামটির অন্তত ৪০টি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। একটি বাড়িতে এ একটি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় চারটি বাড়ির নয়টি খড়ের গাদা। তবে এখানেই ঘটনার শেষ নয়। এরপর গ্রামের ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৪০-৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয় যার অনেকেই ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ভুক্তভোগী। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরাই এই হামলার জন্য দায়ী।
কুমিল্লা শহর থেকে বেতাগা গ্রামটি প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের প্রায় সব বাড়িই টিনের। নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও বেতাগা গ্রামে এখনো সেদিনকার তাণ্ডবলীলার চিহ্ন জ্বল জ্বল করছে। শুক্রবার বেলা সাড়ে এগারোটায় সেখানে গেলে ভূক্তভোগীরা এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। তারা বলতে থাকেন এর আগেও অনেক সাংবাদিক এসেছিল, কিন্তু কেউই কিছু লেখেননি। গ্রামটির আধা কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে চালানো হয়েছিল এই তাণ্ডব। প্রতিটি বাড়িরই বাইরের টিনের বেড়া ঘরের টিনের মধ্যে রামদা, চাপাতি আর কিরিচের কোপের চিহ্ন। পোড়া খড়ের ছাই এখনো স্তূপ হয়ে রয়েছে।
বেতাগা গ্রামটি কুমিল্লা ১০ আসনে পড়েছে। তিনটি উপজেলা নিয়ে এই আসনটি ভোটার সংখ্যা ও আয়তনে কুমিল্লার সবচেয়ে বড়। এখানে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়বেন পরিকল্পনা মন্ত্রী ও এই আসনের বর্তমান সাংসদ আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জবমোহনপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় ২৪ অক্টোবর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর হয়ে এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সায়েমা ফেরদৌস। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজ নেতা কর্মীদের বাড়িতে একের পর এক হামলা, মামলা এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি প্রচারণা থেকে সরে যান।
গ্রামবাসী ঘটনার বিষয়ে যা জানালেন তা হলো, একদল যুবক অটোরিকশাতে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার গান বাজাতে বাজাতে তাদের গ্রামে আসেন। সেখানে তাঁরা বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরীর (কারাগারে আছেন) পোস্টার টানানো দেখে কিরিচ দিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় বিএনপি সমর্থকেরা তাদের বেধড়ক পেটান। এর জের ধরে বিকেল ৫ টা ৪০ মিনিটের সময় হেলমেট পড়া শতাধিক যুবক অতর্কিতে তাদের গ্রামে হামলা চালান। আধা ঘণ্টা ধরে চলে তাণ্ডব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, প্রথম ঘটনার পরপরই চারটি গাড়িতে করে পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। হামলা, অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের সময়ও তারা সেখানে ছিলেন। কিন্তু হেলমেট পড়া উন্মত্ত যুবকদের তারা বাধা দেয়নি।
হামলায় নিঃস্ব জাহানারা বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার পুড়ে যাওয়া ঘরটির সামনেই। একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন এই নারী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ছয় বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। এরপর দুই ছেলের দৈনিক আয় আর চায়ের দোকান থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই সংসার চলত। বাড়ি বানাতে গিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছিলেন। পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার-দেনা করেছিলেন আরও দুই লাখ টাকা। এসব তিনি কীভাবে শোধ করবেন তাই এখন ভেবে কুল পাচ্ছেন না।
সেদিনকার পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনাটি ঘটেছিল আবুল বাশারের চায়ের দোকানের সামনে। হেলমেট পড়া যুবকেরা যখন হামলা চালান, তখন তাঁর চায়ের দোকানটি পুড়িয়ে দেয়। পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র এখনো সরাননি তিনি। আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার কিছু লোক তার কাছে টাকা রাখতেন, অনেকটা সমবায় সমিতির মতো। এর ৭৫ হাজার টাকা ছিল দোকানে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জিনিসপত্রও আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আবুল বাশার বলেন, সবকিছু তো হারালেনই। এখন আবার তাঁকে মামলার আসামিও করা হয়েছে।
হামলার সময় তাদের ঘরের জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন গ্রামবাসী। কৃষক আবদুল কাদের বলেন, কুপিয়ে ঘরের সব টিন ছিন্নভিন্ন করার পর যুবকেরা তার দুটি বাইসাইকেল এবং দুটি শ্যালো মেশিন নিয়ে যায়।
কৃষক মোবারক শরীফের দেখালেন তারা পুড়িয়ে দেওয়া তিনটি খড়ের গাদা। বললেন, পালিত তিনটি গরুর সারা বছরের খাবার ছিলো এগুলো। কিন্তু সব শেষ।
এই ঘটনায় মামলার বাদী মো. জয়নাল আবেদীন রিয়াদ (সৌদি আরব) শাখা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগের সহ-সম্পাদক। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ওই দিন বেলা সাড়ে চারটার সময় তিনি বেতাগা গ্রাম দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন একদল লোক তাঁকে বেধড়ক পেটায়। পরে পুলিশ এসে তাঁকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। তিনি আগে কি ঘটেছিল তা জানতেন না। হঠাৎ হামলার শিকার হয়েছেন।
মনিরুল হক চৌধুরীর মেয়ে সায়েমা ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, বেতাগা গ্রামের ওই ঘটনায় তারা থানায় মামলা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো তাদের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে এখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
মন্তব্য
মন্তব্য করুন প্রথমআলো.কম এ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আম্লীগ দেশকে একেবারে শেষ করে দিলো। ডিভাইড এন্ড রুল , ভাই এর সাথে ভাই এর লড়াই। কবে যে মিডল ইস্ট এর মতো আমাদের দশা হয় !
mahamud
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
Now tell me who are 'RAJAKAR"?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত !
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
এই নির্দোষ অসহায় মানুষগুলুর চোখের পানিতে খোদার গজব নেমে আসলে এসরকারের পক্ষে দুনিয়ার সমস্ত জরিপও উল্টো হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
লজ্জা আর লজ্জা। এই জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছে??
Miraz Khan
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
This is the scenario of all over the country. shame!
Masum Zaman
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
just seek assistance from Allah, he's almighty only he can save us from jahannam in BD.
ফরিদ
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
র্যাবের মহাপরিচালক সাহেব যদি শুনে থাকেন, আশা করি তিনি তার কথা মত দুষ্কৃতিকারীদের "হাত ভেঙে" দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন।
S. M. Abdul Haque
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
Not easy...
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
Where is the humanity group?
FaruQue Khan
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আহাহা কি সুবিধা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
প্রথম আলোকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক সাহসী একটি রিপোর্ট। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের রিপোর্ট সাধারণত সরকার দলীয় নেতার বক্তব্য, বিরোধী দলীয় বক্তব্য এবং পুলিশের বক্তব্য দিয়ে লেখা হয়। এসব ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে আমরা ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দিহান থেকে যাই। মিডিয়ায় এ ধরনের রিপোর্ট দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য দিয়ে করা এই রিপোর্টটি অসাধারণভাবে মানুষের কথা, ঘটনার সত্যতা তুলে ধরেছে। রিপোর্টারের এই সাহসী পদক্ষেপের কারণে তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
হিংসা-হানাহানির রাজনীতি বন্ধ না হলে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে না, দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে না। উভয় দলেরই উচিত সংযত আচরণ করা।
Mohasin Kabir
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
এরা কখনোই সন্ত্রাসী হতে পারে না পুলিশের চোখে কিন্তু জনগণের চোখে এরা হলো হেলমেট বাহিনী এবং বাংলাদেশের এক নাম্বার সন্ত্রাসীলীগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
"তারা বলতে থাকেন এর আগেও অনেক সাংবাদিক এসেছিল, কিন্তু কেউই কিছু লেখেননি।" ঐ সব সাংবাদিক নামের কলংক । তারা কলমের শক্তি কি তা না বুঝেই সাংবাদিক হতে গেছে ।এতবড় ক্ষতি হয়ে গেছে এই মানুষদের তারা অসহায়ের মত আপনাদের সাহায্য চেয়েছিল আর আপনারা!!! ছিঃ ঐসব সাংবাদিকদের বলছি এই মহান পেশা ছেড়ে বাসায় চুড়ি পর বসে থাকেন ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আওয়ামী লীগের বর্বরতার এমন নজির বিরল নয়। এটা সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অনাচারের নমুনা মাত্র। বহু স্থানেই তারা হামলা করে আক্রান্তদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। পুলিশ সবসময়ই হামলাকারীদের পক্ষে থেকেছে। জনমানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে তারা কোন ভূমিকা রাখেনি।
Mobassir Hossain
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
" শুক্রবার বেলা সাড়ে এগারোটায় সেখানে গেলে ভূক্তভোগীরা এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। তারা বলতে থাকেন এর আগেও অনেক সাংবাদিক এসেছিল, কিন্তু কেউই কিছু লেখেননি।" হে প্রথম আলো... তুমি সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতেই পছন্দ কর । তুমি সাহসি, তুমি নিরপেক্ষ । সেটা আওয়ামীলীগ হোক অথবা বি,এন,পি হোক । জানি তোমাদের নামে অজস্র মামলা আছে । হুমকি, ধমকি পাচ্ছ তারপরেও তোমরা সত্যটা তুলে ধরতে পিছপা হওনা । তাই তোমার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা । প্রতিদিন শুধু তোমার পত্রিকাই পরি সেই সুধুর প্রবাস জিবনে । ভালো থেকো ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
মনে হচ্ছে মিয়ানমারের ভিতর রোহি্গ্গার অবস্হান।হায়ানার আক্রমণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আহারে বাংলাদেশ!!!!!!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, প্রথম ঘটনার পরপরই চারটি গাড়িতে করে পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। হামলা, অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের সময়ও তারা সেখানে ছিলেন। কিন্তু হেলমেট পড়া উন্মত্ত যুবকদের তারা বাধা দেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আবারো হেলমেট বাহিনী!!! প্রথমআলো বাদে প্রায় বাকি সব মিডিয়া এখন বিটিভি হয়ে গেছে!!!
reja khan
০১ জানুয়ারী, ২০১৯
পরের ঘটনার সবাই সন্ত্রাসী, কিন্তু প্রথম ঘটনার সবাই কি সাধু পুরুষ?? ঘটনার উৎস যেহেতু প্রথম ঘটনা থেকে, সুতরাং প্রথম ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে, সেসব সন্ত্রাসীদের বিরূদ্ধে মামলা হতে আপত্তি কেনো??